দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে বিরাজ করছে নানা মুনির নানা মত । পক্ষান্তরে এই নানা মুনির নানা মতের অন্তরালে দুটি মত সর্বান্তক পরিচিতি লাভ করেছে।তন্মধ্যে এক. এখনই খুলে দেওয়া হোক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।দুই. আর কিছুদিন করে সময় নেওয়া হোক, তারপরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হোক। তবে কিছুদিন আগেও দ্বিতীয় মতটির সর্বজনীনতা থাকলেও ইদানিং প্রথম মতটির দিকেই ঝুঁকছে কমলমতি শিক্ষার্থীরাসহ শিক্ষক ও অভিভাবকেরা।
ইতোমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক বিশাল দলও তৈরি হয়েছে এবং সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে তারা নাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য আন্দোলনেও নেমেছে।
তবে সরকার থেকে যে মত আসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে তা ওই দ্বিতীয় মতেরই অন্তর্ভুক্ত। তবে বর্তমান যে প্রক্ষাপট উপলদ্ধি করা যাচ্ছে সেরকম উপলদ্ধি থেকে বলা চলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খুলে দিলে পরিস্থিতি আরও জটিল থেকে জটিলতর হবে।শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়াই যেন সবকিছুর একমাত্র সমাধান ও সময়ের দাবি বটে! ইউনেস্কোর তথ্যানুসারে, বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে বিশ্বে এক শত বাহাত্তর কোটি পঞ্চাশ লাখ শিক্ষার্থী শিখনবঞ্চিত হচ্ছে।শিক্ষার সব ক্ষেত্রের মোট ৯৮.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে ।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে। প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী শিখন ক্ষতির সম্মুখীন । এই শিখন ক্ষতি প্রকৃতপক্ষে জাতির যেকোনো ক্ষতির থেকে ভয়াবহ। এর প্রভাবও দীর্ঘমেয়াদি। এই বড় সংখ্যক শিক্ষার্থীদের শিক্ষাঅঙ্গন থেকে ঝড়ে পড়ার ফলে দেশ অন্ধকারচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে । পাশাপাশি স্বার্থান্বেষী মানুষেরা শিক্ষার্থীদের দিয়ে কম মূল্যে শ্রম কিনে নিচ্ছেন। এছাড়া মুনাফাখোররা এই বড় সংখ্যক শিক্ষিত শিক্ষার্থীর শিক্ষা প্রাঙ্গন থেকে পিছিয়ে পড়া কিংবা দূরে সরে যাওয়ার ফলে তারা তাদের স্বার্থ অনায়াসে হাসিল করে নিচ্ছে।
এক শ্রেণী চাচ্ছে মেধাশূন্য করে দিতে এদেশকে । যাতে করে কতিপয় সাম্রাজ্যবাদীরা এসে এখানে উপনিবেশ চালাতে পারে । যেমনটি হরহামেশায় হয়ে থাকে।এদেশ সোনা দিয়ে মোড়ানো।
যার জন্য প্রতিপক্ষ কিংবা মুনাফাখোরদের বারংবার দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে এদেশের প্রতি। কীভাবে এদেশের মানুষদের মেধাকে আত্নঃসারশূন্য করে তাদের কতিপয় কতৃত্ব অব্যাহত রাখতে পারে। তাদের কন্ঠকে, কারচুপি, কারসাজি, জালিয়াতি, দুর্ণীতি ও অপরাধ যেন কেউ দমাতে না পারে সে জন্যই এরকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখার কারণ হতে পারে। মূলত এসকল কিছু দূর করে দেশের মানুষদের আলোর পথে নিয়ে যেতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিকল্প নেই।
এছাড়া বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলার ফলে রুজি-রোজগার হারিয়েছে লাখো মানুষ। কর্মহীন দিন পাড় করছে অনেকেই।
কথিত, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।এভাবে অলসতায় ও কর্মহীন থাকার ফলে স্বার্থান্বেষী মানুষ তাদেরকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে খারাপ কাজ করিয়েও নিতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এর তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সাল শেষে বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ। অতিদারিদ্র্যের হার সাড়ে ১০ শতাংশ। দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫৬ লাখ। সেই হিসাবে দেশে ৩ কোটি ৪০ লাখ গরিব মানুষ আছে। তাদের মধ্যে পৌনে দুই কোটি মানুষ হতদরিদ্র(সূত্র:প্রথম আলো)।
ইতোমধ্যেই দেশে ব্যাপক সংখ্যক দারিদ্র মানুষ রয়েছে। যাদের মধ্যে অনেকেই দিন আনে দিন খায়। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের ফলে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় বিরাজ করছে তারা।
এছাড়া পার্স টুডে থেকে জানা যায়, করোনায় বাংলাদেশে দিন আনা মানুষের ৭০ শতাংশ কর্মহীন। এই মাত্রারিক্ত শতাংশের অধিকাংশ তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কিংবা শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করে। অথচ আজ সকল প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে না। যার ফলে অনেকেই পুনঃরায় কর্মে নিয়োজিত হতে পারলেও এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক কর্মচারীরা তাদের কর্ম পুনঃবহাল করতে পারছে না।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া প্রয়োজন সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে।দীর্ঘ দিন ধরে করোনা নামক বাঘবন্দি খেলায় ঘরবন্দি যার ফলে পড়াশোনা কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সকলেই দূরে সরে গেছে। অনলাইন ভিত্তিক ক্লাস হলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে। আর যারা ক্লাস করে তারাও অমনোযোগী থাকে।পাশাপাশি অনলাইন নির্ভর ক্লাসের ফলে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির অপব্যবহার এ লিপ্ত হচ্ছে। পড়াশোনার চেয়ে বেশি গেমিং কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় নষ্ট করছে।পাশাপাশি প্রযুক্তিতে আসক্তি হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে একঘেয়েমি বিরাজ করছে এখন সকলের।
করোনা দিনে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি নিয়েও ওঠেছে নানা প্রশ্ন। যেমন উন্নত দেশে অর্থাৎ ইতালি ও স্পেনের পিতামাতাদের মতানুযায়ী, চলমান সংকটে ৭৭ শতাংশ বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মনোযোগহীনতা দেখা গেছে। ৩৯ শতাংশ বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে অস্থিরতা ও খিটখিটে মেজাজ ও রাগান্বিত অবস্থা।স্নায়বিক দুর্বলতা দেখা গেছে ৩৮ শতাংশ বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এবং একাকীত্বে ভুগেছে ৩১ শতাংশ শিশু। যুক্তরাজ্যে আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, দেশটির ৩২ শতাংশ তরুণ-তরুণীর মানসিক স্বাস্থ্যের অনেক অবনতি ঘটেছে বলে জানা গেছে। মানসিক সংকটে আছেন ২৬ শতাংশ।
উল্লেখ্য ২০০০ সালে সার্স মহামারির সময়ে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গিয়েছিল। আর করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বের শত শত কোটি মানুষ ঘর-বন্দি হয়ে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকায় এসময় মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি আরো বেশি বলে দাবি করছে। তথাপি বাংলাদেশও এর ব্যাতিক্রম নয়। করোনাদিনে প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকায় মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির ফলে আত্মহত্যার কথাও শোনা যায়। পক্ষান্তরে এসকল বিষয় রোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া শিক্ষার্থীদের সেশন জট যেন অন্যতম এক সমস্যা।
লাখো শিক্ষার্থীরা জল্পনা কল্পনা করে থাকে তারা দ্রুত উপরের শ্রেণীতে ওঠুক, চাকরিতে নিয়োগ পাক অথচ করোনা যেন সব ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। যেসকল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্ররা সেকেন্ড টাইম এডমিশন দিয়ে চান্স পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের যেন কষ্টের সীমা নেই। বসে বসেই তাদের জীবন থেকে দুবছর চলে যাচ্ছে । কত স্বপ্ন নিয়ে নাই তারা এসেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে! পরন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিরুদ্ধে অনেকে থাকলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া জরুরি। অনেকেই বলবেন, বাচ্চাদের নিরাপত্তা কিংবা বাঁচা মরার কথা নিয়ে। এ বিষয়ে প্রথম মন্তব্যটি করবো বাঁচা মরা আল্লাহর হাত।
কে কখন বাঁচবে না মরবে স্বয়ং তিনি নির্ধারিত করে থাকেন। তাছাড়া কোভিড আক্রান্ত হলে সকলেই যে মারা যায় তা নয। ৮০ শতাংশ মানুষ ঘর থেকেই সুস্থ হয়ে ওঠে। অপরপক্ষে কর্মস্থান গুলো সবই খুলে দেওয়া হয়েছে যেখানে আমাদের পিতা মাতা কিংবা ভাই-বোনেরা কাজ করছে। তারাও জীবিকার তাগিদে রিস্ক নিচ্ছে। তবে কেন আমরা নয়? আমাদেরও উচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে যেয়ে পুনঃরায় শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খুললে কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়ে যেতে পারে প্রতিষ্ঠানগুলোর।
তবে আমরা যারা অপেক্ষা করছি করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হোক পুরোপুরি তাদের উদ্দেশ্য বলা যেতে পারে, করোনা অতি সহজে যাওয়ার মতো ভাইরাস নয়। ইতিমধ্যে অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিন ট্রায়ালে এক জন অসুস্থ হয়েছেন এবং ট্রায়াল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে
(সূত্র : কালেরকণ্ঠ)। তাছাড়া দেশে সবকিছুই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফেরত আনার সর্বাধিক চেষ্টা চলছে। তবে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় আমাদের এতো ঝামেলা কেন?
শুধু আমাদের নিজেদের জন্যে অন্য পরিবার গুলো কষ্ট করছে। প্রত্যক্ষভাবে অনেকেই বিচলিত, মর্মাহত ও কর্মহীন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলার ফলে।
যেখানে আমাদের পিতা, মাতা, ভাই ও বোনেরা কর্মস্থলে ফিরে আমাদের দেখভাল করছেন সেখানে আমাদেরও উচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবি তুলে, জনমত কিংবা ঐক্যমত গড়ে তুলা নিজেদের জন্যে, নিজের পরিবারের জন্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক নির্ভর পরিবারের জন্য। সর্বোপরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা উচিত আমরা সকলেই সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত তবে বর্তমানে দেশীয় যে পরিস্থিতি এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিকল্প নেই।
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্ধন এবং শিক্ষাস্তর গতিশীল করার লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া উচিত।পরিশেষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া জরুরি। তথাপি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া সম্পর্কে অতি দ্রুত সরকার পদক্ষেপ নিবে বলে আশা ব্যক্ত করছ।
মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক ও সংবাদকর্মী, কক্সবাজার।