নাটোর সদর থানায় চাকরি করাকালীন থাকতাম একটি নির্মাণাধীন ব্যারাকের দোতলায়। ঘরের জানালা দরজা কিছুই ছিলনা। আমি একা থাকতাম। একদিন রাত ২টার সময় ঘুম ভেঙে যায়। ঘরের বাইরে বারান্দায় এসে নিচে তাকিয়ে দেখি, ৪ ভাইয়ের গলাকাটা রক্তাক্ত লাশ ৪টি গরুর গাড়ির উপর রাখা হয়েছে। তাদের বাড়ি নাটোর জেলার লালপুর থানা এলাকায়। সম্পত্তির কারণে আপন চাচা ও চাচাতো ভাইয়েরা তাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে গলা কেটে হত্যা করেছে। আমি ওইদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। বিছানায় শুয়ে থেকে ভেবেছি, মানুষ কীভাবে এত নির্মম হতে পারে? সেই যে শুরু তারপরে চাকরি জীবনে অনেক লাশ দেখেছি। কোনোটি ছিল হত্যা, আর কোনোটি ছিল আত্মহত্যা কিংবা দূর্ঘটনাজনিত। কিন্তু কোনো মৃত্যুই আমার চোখের সামনে ঘটেনি। আমার আত্মীয়স্বজন অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁদের মৃত্যুর পর আমি সংবাদ পেয়েছি।
১৯৯১ সালে আমি আমার মাকে অসুস্হ হয়ে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে চোখের সামনে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছি। মায়ের মৃত্যু আমাকে অনেক কাঁদিয়েছে এবং এখনও কাঁদায়। মায়ের কথা মনে পড়লে আমার দু'চোখ অশ্রুতে ভরে হৃদয়ে বয়ে আসে অনেক বেদনার ঝড়। দোয়া করি মাগো তুমি পরকালে ভালো থেকো। তোমাকে যে ক্ষনিকের জন্য ভুলতে পারিনা, কখনও ভুলবোনা।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষাবাহিনির সদস্য হিসেবে সুদানের দারফুর প্রদেশের রাজধানী নিয়ালার একটি ক্যাম্পে চাকরি করাকালীন বিদ্রোহীরা আমার চোখের সামনে সুদান পুলিশের একজন সদস্যকে হত্যা করে অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়। আমাদের ক্যাম্প থেকে মাত্র ৫০০ গজ দূরে ছিল তাঁর ক্যাম্প। ভদ্রলোক সবসময়ই আমাদের ক্যাম্প থেকে পানি নিতে এসে গল্প করতেন। তাঁর গল্প বলা কখনও শেষ হতো না। ক্যাম্প থেকে না ডাকলে তিনি যেতে চাইতেন না। তিনি শোনাতেন তাঁর স্বপ্নের কথা। তিনি বলতেন, তার একটি মাত্র মেয়ে। মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে তিনি তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে চান। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন আর পূরণ হয় না। তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। তাঁর এই মৃত্যুতে আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। এখনও তাঁর কথা মনে পড়লে হৃদয়ে বয়ে আসে অনেক বেদনা। অজান্তেই চোখ দু'টি অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় আমি ৬ জন করোনা রোগীকে চোখের সামনে মৃত্যুবরন করতে দেখেছি। প্রতিটি মৃত্যুই আমার হৃদয়ে বেদনা বয়ে এনেছে । একজন মা ভর্তির পর থেকে তার করোনাক্রান্ত ছেলেকে কোলে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতেন। এ অবস্হায় তাঁর মৃত্যু হয়। আমার সামনের সিটের একজন তাঁর স্ত্রীর হাত জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতেন। কিছুতেই স্ত্রীর হাত ছাড়তেন না। এ অবস্হায় তিনি মৃত্যুবরন করেন। আমার ডান পাশের শেষ দিকের বেডের একজন রোগী ভর্তির পর থেকে সবসময় কালেমা পড়তেন। মৃত্যুর আগে তিনি স্ত্রীকে তাঁর সাথে বেডে গলা জড়িয়ে শুতে বলেন। স্ত্রী স্বামীর শেষ ইচ্ছে পুরণ করেন। স্ত্রীর গলা জড়িয়ে ধরা অবস্থায় কিছুক্ষনের মধ্যে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। আরেকজন করোনা রোগীকে ওয়ার্ডে ঢোকানোর সময় দরজায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অক্সিজেনের অভাবে তার মৃত্যু হয়। আর মাত্র ৪/৫ হাত গেলে তিনি বেডের সাথে লাগানো অক্সিজেন পেতেন। কিন্তু সে সুযোগ আর হয়নি। তার আগেই তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। তাঁর মৃত্যুতে আত্মীয়স্বজনদের আহাজারি আর কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠেছিল। আমার বেডের ডানদিকে নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর থানা এলাকার একজন রোগী ছিলেন। তিনি করোনাক্রান্ত হয়ে আমার আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। রাতে আমাদের ঘুম হতো না। আমরা প্রায় প্রতি রাতে অধিকাংশ সময় জেগে বেডে বসে থাকতাম। নওগাঁর ভদ্রলোক যেহেতু আমার বেড সংলগ্ন ডানদিকের বেডে ছিলেন, সেহেতু তার সাথে আমার সবসময় কথা হতো। বিশেষ করে রাতের বেলায় ঘুম না হলে আমরা বেডে বসে থেকে কথা বলতাম। তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার জন্য অনেক উদগ্রীব ছিলেন । তার দু'মেয়ে এবং ছেলের স্ত্রী হাসপাতালে সার্বক্ষণিক তাঁর সেবা যত্ন করতেন। তাদেরও অনেক আশা ছিল সুস্থ হওয়ার পর বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু তাদের আশা আর পূরণ হয় না। হঠাৎ সবাইকে কাঁদিয়ে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। তাঁর মৃত্যুতে আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। আর একজন রোগীকে মুমূর্ষু অবস্থায় আইসিইউতে নিয়ে গেলে সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কয়েকদিনের ব্যবধানে এত মৃত্যু আমার হৃদয়কে নাড়া দিয়ে খুব ব্যথিত করে তোলে। চোখের সামনে আমি এত মৃত্যু আর কখনও দেখিনি। আমার ডান ও বামপাশে আরও দু’টি করোনা ওয়ার্ড ছিল। ওই দু'টি ওয়ার্ড থেকে কিছুক্ষন পরপর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতো। আমরা বুঝতে পারতাম কোনো না কোনো রোগী মৃত্যুবরণ করেছেন। আসলে করোনা ওয়ার্ডগুলি ছিল মৃত্যুপুরী। সারাদিন ও রাতে কত রোগী যে মারা যেতেন তার হিসেব রাখা ছিল কষ্টকর।
আমি একসাথে করোনা এবং নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। স্ত্রী ও খালাতো ভাই আমাকে রাতে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান। আমার ফুসফুস ৮৭% ডেমেজ হয়ে গিয়েছিল। অবস্থা ছিল খুবই আশঙ্কাজনক। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে আমার মুখে অক্সিজেন লাগানো হয়। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সকালে জ্ঞান ফিরে এলে দেখি আমার স্ত্রী ওয়ার্ডের বাইরে বসে আছেন।সেবিকারা সেলাইনের সাথে সাথে আমার হাত ও পেটের নাভীতে প্রতিদিন ৬টি ইনজেকশন পুশ করতেন। তারা এলে আমি খুব আতঙ্কে থাকতাম। নাভীতে ইনজেকশন নেয়া যে কী কষ্টকর তা বলে বোঝাতে পারবো না। রক্ত যাতে জমাট না হয় সেজন্য নাভীতে ইনজেকশন দেয়া হতো।
আমি করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা শুনে ঢাকায় অবস্থানরত আমার ডাক্তার ছেলে, ডাক্তার মেয়ে এবং ডাক্তার বৌমা রাতেই রওয়ানা হয়ে সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে পৌঁছে। করোনা ওয়ার্ড ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ন। সুস্থ লোক এই ওয়ার্ডে প্রবেশ করলে করোনা রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সতর্কতা জারি ছিল। ডাক্তার মেয়ে ২ দিন থাকার পর ঢাকায় চলে যায়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ডাক্তার বৌমা এবং সন্ধ্যা থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত ডাক্তার ছেলে আমাকে ঔষধ ও খাবার খাওয়ানো, অক্সিজেনের মাস্ক মুখে ঠিকমতো লাগানো আছে কী না, সেলাইন শরীরে ঠিকমতো পুশ হচ্ছে কী না , অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ানো ও কমানো, জ্বর ও প্রেশার মাপা, ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কাজ করতো। তারা যেহেতু ডাক্তার তাই আমার পাশাপাশি ওয়ার্ডে থাকা ৭ জন রোগীরও সেবাযত্ন করতো। প্রতিটি বেডে যেয়ে ব্যক্তিগতভাবে রোগীদের ভালো মন্দ খোঁজ খবর নিত। এ ধরণের কর্মকাণ্ডের জন্য তারা কর্তব্যরত ডাক্তার, সেবিকা, রোগী এবং তাদের আত্মীয়স্বজনদের কাছে খুব প্রশংসিত হয়। তারা ক্রমশ ওয়ার্ডে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ছেলে ও বৌমা আমাদের সবার মনোবল বাড়ানোর জন্য সবসময় উৎসাহ দিতো। বিভিন্ন ধরণের গল্প ও কথা বলে আমাদের মন ভালো করার চেষ্টা করতো।ওয়ার্ডে সবচেয়ে কষ্টকর ছিল মুখে লাগানো অক্সিজেনের মাস্ক খুলে ওয়াশরুমে যাওয়া। সেখানে নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হতো। অনেকে পড়ে যেতেন। পড়ে গেলে তাদেরকে তুলে আনতে আমার ডাক্তার ছেলে ও ডাক্তার বৌমা রোগীর আত্মীয়স্বজনকে সবসময় সাহায্য করতো। এমনকি বাইর থেকে কোনো রোগির ঔষধ কেনার প্রয়োজন হলে তারা তা এনে দিতো।
ডাক্তার ছেলে রাতে আমার সাথে বেডে শুয়ে থাকতো। এটি ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ন। ওই ওয়ার্ডে আর কেউ করোনাক্রান্ত রোগীর সাথে এক বেডে থাকতেন না। পাশে আলাদা চেয়ারে বসতেন। অথবা রাতে মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে থাকতেন। ব্যতিক্রম ছিল একমাত্র আমার ডাক্তার ছেলেটি। একদিন রাতে মুখে লাগানো অক্সিজেনের মাস্ক খুলে যায়। তখন আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আমি খুব জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকি। আমার জোরে নিশ্বাস নেওয়ার শব্দ শুনে ছেলে জেগে উঠে আমার অবস্হা দেখে দ্রুত অক্সিজেনের খুলে যাওয়া মাস্ক মুখে লাগিয়ে দেয়। আল্লাহতায়ালার অশেষ রহমতে আমি অল্পের জন্য বিপদ থেকে রক্ষা পাই। ছেল না থাকলে ওই দিন আমি বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হতাম। আল্লাহপাক আমাকে রক্ষা করেন। আমি ১৪ দিন চিকিৎসাধীন থেকে ৯৮% সুস্থ হয়ে করোনাকে জয় করে বাড়িতে ফিরতে পারলেও আমার ডাক্তার ছেলে, মেয়ে এবং বৌমা করোনা রোগে আক্রান্ত হয়। যেহেতু তারা করোনা ওয়ার্ডে আমার সাথে অবস্থান করেছে, তাই তারা সেখান থেকে সংক্রমিত হয়। তাদের কাছ থেকে আমার স্ত্রীর শরীরে সংক্রমণ হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার শরীরের ওজন ৭৩ কেজি থেকে নেমে ৬০ কেজি হয়েছিল। আমার জীবনে হাসপাতালে থাকা ওই ১৪ দিন এক কালো অধ্যায় যা আমি ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারিনা। বিশেষ করে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া ৬ জনের কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনা। তাদের কথা মনে পড়লেই আমার দু'চোখ পানিতে ভরে ঝাপসা হয়ে আসে।
আমার মায়ের মৃত্যু, সুদান পুলিশের সদস্যসহ করোনা ওয়ার্ডের প্রতিটি মৃত্যু আমাকে বারবার কাঁদিয়েছে। রোগীর মৃত্যুর পর আত্মীয়স্বজনদের আহাজারি আর কান্নার রোলে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারতাম না। রাতে মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে তাঁদের মুখ ভেসে এসে দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। বুক থেকে বের হয়ে আসে দীর্ঘ নিশ্বাস। বন্ধুরা আর কিছু না হোক তোমাদের জন্য সবসময় দোওয়া করে যাচ্ছি - পরকালে তোমরা ভালো থেকো। তোমাদের যে ভুলতে পারিনা। কী করে ভুলবো তোমাদের?
লেখক ও কলামিস্ট :